‘হঠাৎ শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে, চিৎকার-কান্না শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি’


প্রকাশের সময় : জুলাই ৮, ২০২৪, ১:০২ অপরাহ্ন / ৬২
‘হঠাৎ শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে, চিৎকার-কান্না শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি’

‘রথের গাড়ির নিচেই রশি ধরেছিলাম। সেউজগাড়ি আমতলা মোড় অতিক্রম করার সময় হঠাৎ শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। পেছনে তাকিয়ে দেখি, রথ ধরে থাকা বহু মানুষ ঝাঁকুনি খেয়ে ছিটকে পড়েছেন সড়কে। চিৎকার, কান্না, আহাজারি। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’ কথাগুলো বলছিলেন বগুড়া শহরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হতাহতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মিতালী রানী পাল (৫২)। বগুড়া শহরের স্টেশন সড়কের সেউজগাড়ি এলাকায় গতকাল রোববার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৪৩ জন। এই রথযাত্রা বের হয়েছিল শহরের সেউজগাড়ি পালপাড়া এলাকা থেকে। আয়োজকের দায়িত্বে ছিল সেউজগাড়ি পালপাড়া আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন মন্দির)। দুর্ঘটনার কয়েক মিনিট আগে বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান, জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী রথযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। শহরের সেউজগাড়ি আমতলা মোড় অতিক্রম করার সময় রাস্তার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে রথের চূড়ার সংঘর্ষ লেগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে।

১৭ ঘণ্টা আগে বগুড়ায় রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৫ জনের মৃত্যু, আহত অর্ধশত আজ সকাল আটটায় সেউজগাড়ি পালপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মহল্লাজুড়ে শোকাবহ পরিবেশ। পালপাড়া মন্দিরের সরু গলিতে ৮-১০ জন নারীর জটলা। সবার চোখেমুখে বিষাদের ছায়া। সেউজগাড়ি পালপাড়ার বাসিন্দা মালতি পাল (৫৫) বলেন, ‘রথযাত্রা মানে উৎসব আয়োজন, আনন্দযাত্রা। সেই আনন্দযাত্রা বের হওয়ার ১০ মিনিটের মাথায় ঘটে গেল ভয়ংকর দুর্ঘটনা। সড়কের ওপর তার আছে, সেটা তো সবার জানা। তাহলে রথযাত্রার আয়োজকদের কেন সেটা জানা ছিল না? এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল। আয়োজকেরা কী জবাব দেবেন?’

আরতি রানী পাল (৬৫) নামের এক নারী বলেন, ‘এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল; অথচ কারও যেন কোনো দায় নেই। রথ ছিল স্টিলের তৈরি। রথের চূড়া বিদ্যুতায়িত হওয়ার পর রথে যাঁরা হাত রেখেছিলেন, তাঁরাও বিদ্যুতায়িত হন। কেউ ছিটকে পড়েন, কেউ হতাহত হন।’ সেউজগাড়ি পালপাড়া আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন মন্দির) ও আনন্দ আশ্রমে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রমের বাসিন্দারা কেউ পাতে খাবার নিয়ে বসেছেন; কেউ পূজা অর্চনায় ব্যস্ত। এক–দুজন দর্শনার্থীও এসেছেন শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে। ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী আনন্দ আশ্রমের বাসিন্দা গিরি রাজ মাধব দাস (৩০) রথের ওপরে চালকসহ ছিলেন ২৫ জন সেবক। দুই পাশে চাকার নিচে কেউ যাতে না পড়েন, এ জন্য দায়িত্বে ছিলেন আটজন সেবক। দুই পাশে রশি টানছিলেন ১০–১৫ হাজার ভক্ত। এর মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
১৩ ঘণ্টা আগে সতর্ক করার পরও মানা হয়নি রথের উচ্চতা, আয়োজকদের দুষছে প্রশাসন রথযাত্রা উৎসব আয়োজক কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তা ও পালপাড়া আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন মন্দির) সেবায়েত (অধ্যক্ষ) খরাজিতা কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৪ সালে থেকে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ও উল্টো রথযাত্রা উৎসবের আয়োজন করে আসছে মন্দির কমিটি। অতীতে কখনো এ রকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেনি। খরাজিতা কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী জানান, এবারের রথযাত্রা দেখভাল করতে ১০০ জন সেবক ছিলেন। সড়কের ওপর বৈদ্যুতিক তারে যাতে রথের স্পর্শ না লাগে, এ জন্য রথের চূড়া ওঠানো-নামানোর জন্য কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া ছিল। আমতলা মোড়ে রথের চূড়া নিচে নামানোর কথা ছিল। রথের চালকও দক্ষ ছিলেন। রথযাত্রা সঠিকভাবে চালানোর জন্য ওপরে ছিলেন ২৫ জন। নিচেও ছিলেন ২০-২৫ জন। দুটি রশি ধরে টানছিলেন ১২–১৫ হাজার ভক্ত। আমতলা মোড়ে রথের চূড়া নিচে নামানোর আগেই ভক্তরা না বুঝে অবিরাম রশি টানতে থাকেন। এতে চালকসহ চূড়া নামানোর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা নিয়ন্ত্রণ হারান। মুহূর্তেই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বগুড়া শহরের রাস্তার ওপর দিয়ে বৈদ্যুতিক তার থাকায় রথের চূড়ার উচ্চতা আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছিল প্রশাসন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, সড়কে বৈদ্যুতিক তারের অবস্থানভেদে রথের চূড়া ওঠানামা করা হবে। কিন্তু তেমনটি না করায় রথের চূড়ার সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার লেগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর নিহত ব্যক্তিদের লাশ সৎকারের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আজ সকালে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে মৃতদেহ নিজ নিজ এলাকায় পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বগুড়ার সিলিমপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. মিলাদুন্নবী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে চারজনের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। তাঁরা হলেন বগুড়া সদরের ছোট বেলঘড়িয়া এলাকার নরেন্দ্র নাথ সরকারের ছেলে অলোক কুমার সরকার (৪২), বগুড়া শহরের পুরান বগুড়া হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা লকেশ্বর চন্দ্র সরকারের স্ত্রী আতশি রানী (৪৫), আদমদীঘি উপজেলার কুন্দগ্রামের ভবানী মহন্তের ছেলে নরেশ মোহন্ত (৬০) ও বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার রঞ্জিতা মহন্ত (৬০)।

অন্যদিকে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে মারা যাওয়া সারিয়াকান্দি উপজেলার সাহাপাড়ার বাসুদেব সাহার স্ত্রী জলি রানী সাহার (৪০) মৃতদেহ তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় আহত ৩৬ জন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন পাঁচজন।